মুক্ত কল ডেক্সঃ ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল, অথচ তার বদলে এখন আহাজারি করতে হচ্ছে। আলু চাষ করে এমন লসের মুখে পড়ছি,” আক্ষেপ করে বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের আলু চাষী আহসানুর রহমান হাবিব। বর্গা ও নিজের জমি মিলিয়ে মি. হাবিব এবছর প্রায় ৯০ বিঘা আলু চাষ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রতিকেজি আলু চাষে অন্তত বিশ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু ফসল তোলার পর এখন তাকে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে গড়ে ১৩ টাকা দরে। বীজ, সার, লেবার কস্টিং মিলায়ে বিঘা প্রতি আমার খরচ পড়েছে লাখের ওপরে। আর এখন আলু বিক্রি করে পাচ্ছি গড়ে ৬৫ হাজার। বিঘায় ৩৫ হাজার টাকা লস,” বলেন হাবিব। বাম্পার ফলন হওয়ার পরও হাবিবের মতো হাজারো মানুষ এবছর আলু চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন।
অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশের বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হতে দেখা গেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রীতিমত হিমসিম খাওয়ার একপর্যায়ে ভারত থেকে আলু আমদানির সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে সরকারকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতি বছর পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ার পরও সংরক্ষণের অভাবে দেশের আলুর বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এর জন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতাই প্রধানত দায়ী, বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি কেমন?
বাংলাদেশে শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর একটি হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ। অন্যান্য বছরের মতো এবারও সেখানকার বহু কৃষক আলু চাষ করেছেন, যাদের একজন শফিকুল রহমান। গত বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম না ওঠায় আমরা একেবারে ধরা খেয়ে গেছি, রহমান। একই কথা জানিয়েছেন মেহেরপুরের আলু চাষী সাদ্দাম হোসেন। কেজি প্রতি বিশ টাকা খরচ করে আলু ফলায়ে এখন আট টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা বাঁচবো কী করে? বলেন হোসেন।
বস্তুত গতবছর আলু চাষে ভালো লাভ পেয়েছিলেন কৃষকরা। ফলে অনেকেই এবার চালু চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। ফলনও হয়েছে ভালো। অন্যান্য বছর যেখানে প্রতি বিঘায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি আলু হয়, এবার সেখানে ফলন পেয়েছি প্রায় ৯০০ কেজি বেশি, বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের চাষী হাবিব। কিন্তু বাম্পার ফলন হলেও সেই পরিমাণ আলু সংরক্ষণের জন্য যত সংখ্যক হিমাগার প্রয়োজন, সেটা কোনো জেলাতেই নেই।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলাটিতে চলতি বছর আলুর উৎপাদন সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর বিপরীতে সেখানকার ৫৮টি হিমাগারে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন আলু রাখা যাবে। এ অবস্থায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কিছুটা লোকসান মেনে নিয়েই আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা। আমরা কী করবো? অন্যকোনো উপায় তো নেই। বিক্রি না করে ঘরে আলু রাখলে সব পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে, বলছিলেন জেলাটির আরেক জন আলু চাষী মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন। এদিকে, হঠাৎ চাপ বেড়ে যাওয়ায় আলু রাখার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন হিমাগার মালিকেরা। এতে উৎপাদকদের মধ্যে যারা আলু সংরক্ষণ করতে চাচ্ছেন, তারা আরও বেকায়দায় পড়েছেন। আগে যেখানে প্রতিকেজি আলু রাখতে চার থেকে পাঁচ টাকা খরচ হতো, সেটা এখন আট টাকা করে চাচ্ছে। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই, বলছিলেন বগুড়ার আলু চাষী মোহাম্মদ মোতালেব। এখানেই শেষ না। চাপ বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন অগ্রিম টাকাও চাচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাবো? বলেন মোতালেব।
হিমাগার মালিকরা কী বলছেন?
আলু সংরক্ষণের খরচ বৃদ্ধির জন্য হিমাগার মালিকদের দুষছেন চাষীরা। তবে মালিকরা অবশ্য দাবি করছেন যে, তারা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াননি। আমরা যে দাম চাচ্ছি সেটা মোটেও অযৌক্তিক নয়, বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের একটি হিমাগারের কর্ণধার সালাম হাওলাদার। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মি. হাওলাদার বলেন, “এখন যে টাকাটা চাওয়া হচ্ছে, সেটাই আমাদের সত্যিকারের খরচ। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে এতদিন আমরা নিজেরা লস দিয়ে কম টাকা নিয়েছি। হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও সম্প্রতি একই দাবি করা হয়।
হিমাগারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের খরচ দিতেই তো সাত টাকা চলে যায়, সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। এ পরিস্থিতিতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান হিমাগার মালিকরা। প্রতিবছর আমরা লস দিবো, সেটা তো হয় না। যাদের কথা ভেবে আমরা এতদিন লস দিয়েছি, তারাই তো কয়েক মাস আগে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করেছে। তাহলে কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া দিতে অসুবিধিা কোথায়?, বলছিলেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. আবু আব্দুল্লাহ। তবে কৃষকদের দাবির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি হিমাগারের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ঘোষিত মূল্য অনুযায়ী, এখন থেকে হিমাগারে আলু রাখতে গেছে প্রতি কেজিতে চাষীদের ছয় টাকা ৭৫ পয়সা করে গুনতে হবে।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদরাঃ ভালো ফলন হওয়ার পরও আলুর সংরক্ষণ ও মূল্য নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। শুধু আলু না, অন্যান্য অনেক ফসলের ক্ষেত্রেও আমরা এই অবস্থা দেখি। কাজেই এটা সরকারের অজানা থাকার কথা না। তারপরও প্রতিবছরই একই ঘটনা ঘটছে, যা খুবই দুঃখজনক, বলছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। কৃষিতে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবেই এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। দেশে বছরে আলুর চাহিদা কতটুকু এবং সেটার বিপরীতে কী পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হচ্ছে? সেই তথ্য কী সরকারের কাছে নেই? এটা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই তো এরকম সংকটে পড়তে হয় না,” বলেন মিজ খাতুন।
বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে কৃষকের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তা না হলে কৃষক পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে, যার ফলে পণ্য সংকটে বাজার অস্থির হবে। সেটার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেন খাতুন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি উদ্যোগেই ফসল ক্রয় ও সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক। সরকারি উদ্যোগেই এটা করতে হবে। তাহলে কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পাবে, তেমনি বাজারে পণ্যেরও সংকট থাকবে না, বলেন খাতুন। এছাড়া উদ্বৃত্ত পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারকে রপ্তানির পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।