সম্পাদকীয়ঃ আমরা আধুনিক ক্রীতদাস শব্দটি যদি মুছে দিতে হলে প্রথমে মানবপাচার বন্ধ করতে হবে। দাস প্রথা বহু আগে শেষ হলেও তা এখন ভিন্ন এক সংস্কারে রয়ে গেছে সমাজে। চোখের সামনে, লাল নীল মোহ-মায়ায় আমরা বরণ করে নিচ্ছি খুব সাদরে, মানবপাচার কেবল একটি গুরুতর অপরাধ নয় এটি মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়ানক অভিশাপ। শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, গোটা সমাজকেও বিপর্যস্ত করে। ব্যক্তি উন্নতির ঝলমলে আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এমন এক অন্ধকার বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। আমি বলবো এক অর্থে এটা আধুনিক দাসত্ব, যেখানে মানুষকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই নির্মম বাস্তবতা আজ শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে এক বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিয়েছে।
তথ্যগুলো নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যায় কতটা ভয়ংকর পরিণতি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি নারী ও শিশু পাচার হয়। বেশিরভাগই ভারত, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যৌন শোষণের জন্য পাচার করা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ২ হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এটি শুধু একটি উদাহরণ, যা মানবপাচারের ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ বাধ্যতা মূলক শ্রম বা যৌন শোষণের শিকার। পাচারের শিকার অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ পাচারের প্রক্রিয়াতেই মৃত্যুবরণ করে। এর পেছনের কারণগুলো হলো অমানবিক পরিবহন ব্যবস্থা এবং শারীরিক অত্যাচার। ইউরোপ আমেরিকাসহ অনেক দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা কিছু বাস্তব চিত্র এই লেখায় তুলে ধরবো, বলবো এর কারণ, প্রতিরোধ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে এবং এনজিওগুলো কীভাবে কাজ করতে পারে আমি দেখেছি জেনেছি এবং শুনেছি কীভাবে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভ্রান্ত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে। মানবপাচার ও আধুনিক ক্রীতদাস এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুসংগঠিত। এদের ছক আঁকানো থাকে, যুক্ত থাকে বহুলোক। পাচারকারী সংঘরা সাধারণত অল্প শিক্ষিত লোকজনকে লক্ষ্য করে এবং লোভ এবং আধুনিক জীবন-যাপনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। এরা এটা খুব ভালোভাবেই আয়ত্ত করে নেয়। উদাহরণ হিসেবে পরিচিত দুই একজনের জীবন কাহিনির বয়ান দেয়। তাদের মতে, ভালো চাকরি, উন্নত জীবনযাত্রা বা শিক্ষার সুযোগ পাবে। পরে এসব মানুষকে অবৈধপথে বিদেশে পাঠায়, যেখানে তাদের নানাবিধ অমানবিক শোষণ শুরু হয়। উন্নত দেশগুলোতেও পাচারের ঘটনা ঘটে, তবে এটি এত সূক্ষ্মভাবে পরিচালিত হয় যে ভুক্তভোগীরা অনেক সময় তাদের পরিস্থিতি বুঝতেই পারে না। তারা জানতেই পারে না তারা স্বাধীন না পরাধীন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ: একজন পর্যটক হিসেবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় দেখেছি, কীভাবে মানুষ পাচারের শিকার হয় এবং এই অভিজ্ঞতা আমাকে খুব হতাশ করেছে এক ভয়াবহ অবস্থা ইউরোপের একটি দেশে এক বাংলাদেশি যুবকের সঙ্গে আমার কথা হয়, যে উন্নত জীবনের আশায় নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে কিছু লোন নিয়ে সেখানে গিয়েছে। কিন্তু পাচারকারীদের প্রতারণার কারণে সে একসময় বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার হয়। দেশ থেকে আসার যেই সময়ের ৫-৭ লাখ টাকা শোধ করতে বহু সময় লেগেছে হেনস্তা হতে হয়েছে তার দেশে থাকা পরিবারকে। মানবপাচারের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিদেশ যাওয়ার উচ্চ খরচ এবং বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুত কাজ না পাওয়া। এর কারণ বিবেচনা করলে বোঝা যায় বাংলাদেশ বা আশপাশে থেকে যারা যায় তারা বেসিক কোনো কাজ পারে না। ভুয়া কাগজপত্র, অবৈধ নিয়োগ পদ্ধতি এবং অনিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থাও এই সমস্যাকে জটিল করে তোলে। মানবপাচারের প্রধান কারণগুলো হলো দারিদ্র্য ও অসচেতনতা জনগোষ্ঠী শিক্ষার অভাব। অবৈধ ওয়ার্কপারমিট। মানবপাচার প্রতিরোধে আইন থাকলেও এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয় না। সবচেয়ে বড় সমস্যা আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের অভাব। মানবপাচার ও আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা সমাধানে বিদেশ যাওয়ার খরচ কমাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়াতে উচিত এবং বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠাতে নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। যেসব কোম্পানি কর্মী নিয়োগ দেয়, তাদের কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। একইসঙ্গে বিদেশে কর্মীদের অধিকার রক্ষায় দূতাবাসের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি মানুষকে পাচারের কৌশল, ঝুঁকি এবং পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মোটিভেট করে তুলতে হবে। তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে এবং দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
এখানে আমরা পাচারের কৌশল, ঝুঁকি এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে জানাবো। এর পরের ধাপে পাচারের শিকারদের আইনি সহায়তা দেওয়া এবং মানসিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর করা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা। শুধু আইনি বা সামাজিক সমস্যা নয় এটি মানবতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে, এই সংকট সমাধান এবং মানবতার এই করুণ ভয়াবহ লজ্জাজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। আমি এও মনে করি দেশে ২৪ লাখ ভারতীয়রা কাজ করে তাঁদের নিজ দেশে ফেরত দিয়ে ঐ স্থানে দেশের শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ছেলে ও মেয়েদের কর্ম সংস্থান করতে পারলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে মাঝে আমাদের যুব সমাজের উন্নয়ন করা সহজ হবে এছাড়াও জেলা উপজেলা, গ্রামগঞ্জে ছোট ছোট কারখানা করে তাঁদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।