মুক্ত কলম নিউজ ডেক্সঃ ঋণের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয়ের বোঝা ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। একসময় সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ৩০ শতাংশেরও কম অর্থ ব্যয় হতো ঋণের সুদ পরিশোধে। কিন্তু চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে
ঋণের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয়ের বোঝা ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। একসময় সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ৩০ শতাংশেরও কম অর্থ ব্যয় হতো ঋণের সুদ পরিশোধে। কিন্তু চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পরিচালন ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে এ খাতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুসারে চলতি অর্থবছরে সরকারকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সামনের দিনগুলোয় ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ আরো তীব্র হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে অপর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিকে আরো সঙ্গিন করে তুলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ অবস্থায় সরকারকে ব্যয় কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ফিসক্যাল প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ পরিশোধেই সবচেয়ে বেশি ৫১ শতাংশ বা ৪২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল পরিচালন ব্যয়ের ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে স্থানীয় ঋণের সুদ পরিশোধে ৩৯ হাজার ২৫২ কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে ৩ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মাসে গড়ে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। বাকি ৯ মাসে এ হারে সুদ পরিশোধ করা হলে অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। যদিও এ খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে উন্নয়ন খাতে সরকার ১০ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা এ খাতে মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
সুদ পরিশোধের পর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা খাতে ১০ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এ সময়ে সরকারকে সামাজিক অবকাঠামো খাতে তুলনামূলক কম ব্যয় করতে হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে খাতটিতে ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে, যেখানে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অতীতের দায় ও চলতি ব্যয় নির্বাহ করতেই আমাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে উন্নয়ন খাতে ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না, যেটি আমাদের প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। এতে ভবিষ্যতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটা সচল করার ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ। অন্যদিকে আমাদের রাজস্ব আয়ও বেশ কম। তাছাড়া উন্নয়ন সহযোগী যারা রয়েছে তাদের কাছ থেকে খুব একটা অর্থ ছাড় হচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি সহসাই সচল হচ্ছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উন্নয়ন ব্যয় না বাড়ালে অর্থনীতি সচল হবে না, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সহসা সচল হবে না এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও আসবে না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে সরকার কত দ্রুত এ স্থবিরতা দূর করতে সক্ষম হয় এবং অর্থনীতির গতিপথটা কত দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি করা সম্ভব হয়নি, যা উদ্বেগের বিষয়। এতে আমাদের প্রবৃদ্ধি ও অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং আমরা কিন্তু পিছিয়ে পড়ছি।’
গত কয়েক অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ও সুদ ব্যয়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর আগে কখনই এ খাতে এত বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে ২৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় হয়েছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ২১ কোটি টাকা এবং সুদ বাবদ ব্যয় হয় ৮৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, যা মোট পরিচালন ব্যয়ের ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে সরকার ৭০ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা বা ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ অর্থ সুদ পরিশোধে ব্যয় করে। কভিডের সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ৭০ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ সুদ বাবদ ব্যয় হয়।
সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ দেশে ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের প্রভাবে তিন বছর ধরেই ঋণের সুদহারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গত নভেম্বরে এ বিলের সুদহার ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। সে হিসাবে সবচেয়ে কম মেয়াদি এ বিলের সুদহার বেড়েছে ৩৯৬ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ গুণ। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ২৭২ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছয় মাস মেয়াদি বিলের সুদহার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। এক বছর বা ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়েছে ২৪৯ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ মেয়াদের এ বিলের সুদহার ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ থাকলেও তা এখন ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার চার-পাঁচ গুণ বেড়েছে ট্রেজারি বন্ডের। গতকাল দুই বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর তিন বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। আরো বেশি মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছুঁয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। যদিও তিন বছর আগে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ মেয়াদি (২০ বছর) বন্ডের সুদহারও ৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার নিজেই ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। এখন সেটি বন্ধ হওয়ায় ট্রেজারি বিলের সুদহার এতটা উচ্চতায় উঠে গেছে। উচ্চ সুদের এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের অর্থ সংকট আরো তীব্র হবে। তখন আরো বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
নিজেদের অর্থে ব্যয় করার সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ঋণ করার প্রবণতা দেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে উল্লেখ করে ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘আমাদের যদি নিজস্ব অর্থ না থাকে তাহলে ঋণ করে ঘি খাওয়ার বিষয়টি হিতে বিপরীত হবে। যত দিন যাচ্ছে দেশী ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের দায়ভার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সামনের বছরগুলোয় এটি আরো বাড়বে। ফলে যদি আমাদের ঋণ করে চলতে হয় তাহলে আগামীর যাত্রাপথ দুর্যোগপূর্ণ করে তুলবে। এ অবস্থায় একদিকে আমাদের ব্যয় কমাতে হবে, অন্যদিকে আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। এ দুটি ক্ষেত্রেই আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এখন পর্যন্ত বিগত সরকারের সময়ে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর বিবরণই আমাদের চোখে পড়ছে। কিন্তু এগুলো কাটিয়ে উঠে কতটা দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি সে চিত্র ততটা উজ্জ্বল নয়। একদিকে সরকারের সুদ পরিশোধের ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত হারে আদায় হচ্ছে না রাজস্ব। চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১২ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার কিছুটা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো বাজেট কমানো হলেও এবার সেটি ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যা এবং জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটির জন্য সরকারের বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে। পাশাপাশি সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় বাড়বে। এসব কারণে এবার বাজেটের আকার খুব বেশি কমানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণের পরিমাণ বাড়ায় সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের ওপর চাপ পড়তে পারে। কারণ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না, যেহেতু কর আহরণ বাড়ছে না।