মুক্ত কলম নিউজ ডেক্সঃ রাজধানীর বিভিন্ন গোস্তের দোকানে ঘুরে দেখা গেছে যে গোস্তের বিক্রির পরিমাণ কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে তিন মাসের ব্যবধানে মাংস উৎপাদন বা ভোগ প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে । প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত জুলাইয়ে দেশে গোস্তের উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ২৫ হাজার টন। কিন্তু আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পটভূমিতে গোস্ত উৎপাদন নেমে এসেছিল ৬ লাখ ৪১ হাজার টনে। সেপ্টেম্বরে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। সে মাসে গোস্তের উৎপাদন হয়েছিল ৬ লাখ ৩৯ হাজার টন। সর্বশেষ অক্টোবরেও গোস্ত উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ছয় লাখ টন। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে দেশে মোট মাংস উৎপাদন বা ভোগ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
দেশের অর্থনীতি আবারও সেই পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে কি না, এ নিয়েই তারা এখন শঙ্কিত। এক-এগারোর পরিস্থিতির মতো দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি একই পন্থায় শিল্প খাতে অরাজক পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তাদের। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে বড় বাঁকবদল ঘটে যায়। সে সময় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে বেছে বেছে শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তাদের হয়রানির মাধ্যমে দেশে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করায় অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। আবারও সেই একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এক জরিপে জানাজায় সরকারি একটি ব্যাংকের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা আবুল কালাম। আগে প্রতি সপ্তাহে গোস্ত কিনলেও এখন মাসে কেনেন দুবার। বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি থাকায় কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। ভোগ প্রবণতায় তাকে বেশ সতর্ক হতে হয়েছে। সরকারি একটি ব্যাংকের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা আবুল কালাম। আগে প্রতি সপ্তাহে গোস্ত কিনলেও এখন মাসে কেনেন দুবার। বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি থাকায় কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। ভোগপ্রবণতায় তাকে বেশ সতর্ক হতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক কমিয়েছেন মাংস খাওয়া।
ক্রেতাদের এমন হিসাবি পদক্ষেপে বিক্রেতাদের বিক্রিও কমেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের জনপ্রিয় গোস্তের দোকানে আগে দৈনিক ১৫-২০টি খাসি গোস্ত বিক্রি হলেও এখন তা নেমেছে ৮-১০টিতে। বিক্রেতা সুমন মিয়া জানান, এখন কাস্টমার কম, তাই বেচা বিক্রিও কম। পাশের মা-বাবার দোয়া মাংস বিতান-এ আগে দিনে তিন-চার মণ গোস্ত বিক্রি হতো। এখন তা আড়াই-তিন মণে নেমে এসেছে। বিক্রেতা এনামুল জানালেন, আগে মানুষের কাজকাম ছিল তাই গোস্ত কিনত। এখন হয়তো কাজ-আয় কমেছে, তাই গোস্ত বিক্রিও কমেছে।
সরকারি হিসাবেও মাংস উৎপাদনের তথ্যে ব্যাপক নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে তিন মাসের ব্যবধানে গোস্তের উৎপাদন বা ভোগ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত জুলাইয়ে দেশে গোস্তর উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ২৫ হাজার টন। কিন্তু আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পটভূমিতে গোস্তের উৎপাদন নেমে এসেছিল ৬ লাখ ৪১ হাজার টনে। সেপ্টেম্বরে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। সে মাসে গোস্ত উৎপাদন হয়েছিল ৬ লাখ ৩৯ হাজার টন। সর্বশেষ অক্টোবরেও মাংস উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ছয় লাখ টন। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে দেশে মোট মাংস উৎপাদন বা ভোগ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
খোলা বাজারে গোস্তের বিক্রি কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ড শপ বা মাংস প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিও কমেছে। পশু খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, বন্যার প্রভাবে এতটা উৎপাদন কমার কথা না। কিছুটা ক্ষতি হলেও সেটার প্রভাব এখনই পড়ার কথা না, বরং পরে সেটার প্রভাব আরো পড়ার কথা। রাজধানীতে এখন গরুর গোস্তের বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। খাসির গোস্তের পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায়। আর মহিষের গোস্তের বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। তবে ভারত থেকে মহিষের চালান কম আসায় মহিষের গোস্তের সরবরাহ কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
গোস্তের উৎপাদনের এমন পতনের তথ্যে সন্দেহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শাহ ইমরান শাহ বণিক বার্তাকে বলেন, তারা কীসের ওপর ভিত্তি করে কীভাবে ডাটা তৈরি করেছে তা আমার জানা নেই। তবে বন্যায় কিছুটা ক্ষতি হলেও এখনই এটার প্রভাবে এত বেশি উৎপাদন কমার কথা না। কারণ বাছুর দুই বছর পর বিক্রি উপযোগী হয়। তাছাড়া বন্যার পর অনেকে ছোট গরুও বিক্রি করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে বাজারে গরু বেশি আসার কথা।
খুচরা বাজারে বিক্রি কমার পাশাপাশি গোস্তের প্রক্রিয়া করণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিও কমেছে। বেঙ্গল মিটের সাপ্লাই চেইন ও রফতানি বিভাগের এজিএম একেএম সায়েদুল হক ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত ফাইভ স্টার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন হোটেলে গোস্তের সরবরাহ করি। সেখানে বিদেশীদের পদচারণ এখন কিছুটা কম। তাছাড়া এসব হোটেলে বড় পার্টিগুলো এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। তাই আমাদের বিক্রিও প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। তাছাড়া মূল্যস্ফীতির প্রভাবে আমাদের রিটেইল শপেও গোস্তের বিক্রি কিছুটা কমেছে।
সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য মাংস উৎপাদন কমার পেছনে বন্যার কারণে সৃষ্ট ক্ষতির কথা বলছেন। এছাড়া বিগত সময়ের অতিরঞ্জিত তথ্য দেখানোর কথাও বলছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. শামছুননাহার আহম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রাম পশু উৎপাদনের একটি বড় কেন্দ্র। সাম্প্রতিক বন্যায় সেখানে ও ময়মনসিংহ এলাকায় অনেক পশু মারা গেছে। তাই মাংস উৎপাদন কমে গেছে। তাছাড়া বিগত সময়ে অতিরঞ্জিত উৎপাদন দেখানো হতো। এখন আমরা মাঠ থেকে প্রকৃত তথ্য আনার চেষ্টা করছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, পশু জবাই না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন দেখানো যায় না। কয়েক মাস আগের বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে গোস্তের প্রক্রিয়াকরণ করা যায়নি। তাই উৎপাদন কমে এসেছিল। টানা ছয় মাস ধরে দেশে ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। সর্বশেষ গত মাসেও তা ছিল ১২ শতাংশের বেশি। মুরগি, ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ সব ধরনের সবজির মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আর চালের মূল্যবৃদ্ধিকে সাম্প্রতিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান প্রভাবক হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
ডব্লিউএফপির সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম ২ হাজার ১০০ ক্যালরি গ্রহণের নির্ধারিত ফুড বাস্কেটের প্রতিটি উপাদানের মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এজন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। জাতিসংঘের এ খাদ্য সংস্থার সাম্প্রতিক আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যে ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ।