সম্পাদকীয়ঃ মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক জোরালো করার জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় চেষ্টা করলেও কেন দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কখনোই গড়ে তোলা যায়নি? গত ২০ বছর যাবত বাংলাদেশের দিক থেকে নানাভাবে আগ্রহ দেখানো হলেও মিয়ানমার সবসময় নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক জোরালো করার জন্য মিয়ানমার কোন প্রয়োজন মনে করছে না।
২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নীতিতে ‘লুক ইস্ট’ বা ‘পূর্বমুখী’ নীতি ঘোষণা করেছিল। সে নীতির মূলে ছিল মিয়ানমারের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। কিন্তু সে উদ্যোগ কোন ফল দেয়নি। তখন বাংলাদেশের পরারাষ্ট্র সচিব ছিলেন শমশের মবিন চৌধুরী। তিনি বলছেন, মিয়ানমারের কাছ থেকে সবসময় সব বিষয়ে ভালো সাড়া পাওয়া যেত না। সে সময় মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল। মি: চৌধুরী বলেন, “মিয়ানমারে দেখাতো যে আমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। মূল কয়েকটি বিষয়ে আমারা তাদের কাছ থেকে সে রকম সাড়া পাই নি। বিষয়গুলো তারা অমীমাংসিত তারা রেখে দিত। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যাটি।
বাংলাদেশ আশা করেছিল মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসান হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হয়েছে। ২০০৯ সালে থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা। তিনি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছিল রোহিঙ্গা ইস্যুটি। যদিও বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে। মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে দেশটি চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
পরবর্তীতে ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে মিয়ানমার। ফলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার বাংলাদেশকে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য মিয়ানমারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলেও মিয়ানমার বাংলাদেশেকে সেভাবে দেখে না। তাছাড়া ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ততটা নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো – থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাণিজ্য বাড়াতে হলে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার হচ্ছে সে অঞ্চলের প্রবেশদ্বার। সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবার জন্য মিয়ানমারকে তাগাদা দেয়া হলেও বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় নি বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আলী আশরাফ মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া চীন এবং ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক জোরালো হবার কারণে বাংলাদেশর তাদের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আশরাফ।