সম্পাদকীয়ঃ আমদের দেশে বিত্তবানরা জাকাত দেন নিজের নাম কামানোর জন্য। তাঁরা মনে করেন গরীবদের করুণা করছেন আসলে তা তাঁদের হোক। প্রতি বছর যদি বিত্তবানরা নিজ নিজ এলাকায় অসহায়দের এক এক সঠিক নিয়মে জাকাত প্রদান করতে তাহলে সে এলাকায় গরীব থাকতো না। বড় লোকরা কম দামী শাড়ী লুঙ্গি বিতরণ করে মনে করেন তাঁদের হোক আদায় করেছেন আসলে বিষয়টি তেমন না। এটি আপনার উপর ফরজ করেছেন আল্লাহ্ পাক। জাকাত মানে যেমন পবিত্রতা, তেমনি রমজান মানে হলো আগুনে পুড়ে সোনা খাদমুক্ত বা খাঁটি করা। রমজানের সঙ্গে জাকাতের সম্পর্ক সুনিবিড়। আল কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাকাত দেওয়ার নির্দেশও ৮২ বার রয়েছে। জাকাত শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সদাকাত’ শব্দ দ্বারা ৯ বার। এর দ্বারা জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন: ‘মুত্তাকিরা জান্নাতের ফোয়ারার কাছে থাকবে। তারা গ্রহণ করবে যা তাদের পালনকর্তা তাদের দেবেন। নিশ্চয় ইতিপূর্বে তারা ছিল সত্কর্মপরায়ণ, তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং তাদের ধন-সম্পদে ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক বা ন্যায্য অধিকার। (আল কোরআন, সুরা-৫১ [৬৭] জারিয়াত (মাক্কি), রুকু: ১/১৮, আয়াত: ১৫-১৯, পারা: ২৬ হা-মী-ম, পৃষ্ঠা: ৫২২/২০)। ‘তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা নামাজ আদায়কারী। যারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে। এবং যাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে যাঞ্ছাকারী ও বঞ্চিতের এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
এবং যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তি সম্পর্কে ভীত-কম্পিত। (আল কোরআন, সুরা-৭০ [৭৯] মাআরিজ (মাক্কি), রুকু: ১/৭, আয়াত: ২২-২৭, পারা: ২৯ তাবারাকাল্লাজি, পৃষ্ঠা: ৫৭০/৮)। সদাকা, জাকাত ও ইনফাক সম্পর্কে কোরআন করিমের সর্বোচ্চ বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘(হে রাসুল!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কী দান করবে? আপনি বলুন, যা তোমার প্রয়োজনের অধিক অথবা যতটুকু দান করলে তোমার অসুবিধা না হয়।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৭/১১, আয়াত: ২১৯, পারা: ২ সাইয়াকুল, পৃষ্ঠা: ৩৫/১৩)। জাকাত মানে প্রবৃদ্ধি আর রমজানে প্রতি ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ তাআলা ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে দেন।
এ প্রসঙ্গে কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা কখনো প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তা ব্যয় করবে, যা তোমরা ভালোবাসো। আর তোমরা যেকোনো বস্তুই ব্যয় করো তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত।’ (আল কোরআন, সুরা-৩ [৮৯] আলে ইমরান (মাদানি), রুকু: ১০/১, আয়াত: ৯২, পারা: ৪ লান তানালু, পৃষ্ঠা: ৬৩/১)।
জাকাত ও সদাকাতুল ফিতর প্রদানে যাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম তাদের প্রসঙ্গটি কোরআনে ঘোষণা হয়েছে: ‘এমন অভাবী লোক, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে (উপার্জনের জন্য) দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে না। সম্ভ্রান্ততার কারণে অনভিজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। আপনি তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন।
তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না। আর তোমরা যে কোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৭/৫, আয়াত: ২৭৩, পারা: ৩ তিলকার রাসুল, পৃষ্ঠা: ৪৭/৫)। এসব বিবেচনায় নিয়ে যুগের চাহিদা ও গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত-ফিতরা আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষ সওয়াবের তারতম্য হবে। যেমন দিনি ইলম অর্জনে সহযোগিতা ইত্যাদি।
ফরজ ও ওয়াজিব সদাকাত, জাকাত ও সদাকাতুল ফিতর যাদের দেওয়া যায় না তাঁরা হলেন: ১) পিতা-মাতা (ঊর্ধ্বতন পুরুষ), ২) ছেলে-মেয়ে (অধস্তন পুরুষ), ৩) ধনী লোক (নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক), ৪) সায়্যিদ (হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধর), ৫) অমুসলিম। পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়েকে দেওয়া যায় না। কারণ, তারা অসচ্ছল হলে তাদের ভরণপোষণ এই ব্যক্তির দায়িত্বে। সুতরাং এদের দিলে আসলে দেওয়াই হয় না বরং নিজের কাছেই থেকে যায়।
জাকাত ও সদাকাত প্রদানের বহু উপকারিতা রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে: ‘দাতা আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে, জান্নাতেরও কাছে; জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা কৃপণ আবেদ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।’ (তিরমিজি শরিফ)। এ ছাড়া জাকাতের সামাজিক অনেক সুফল রয়েছে। জাকাত প্রদান করলে নগদ অর্থ হাতবদল হয়। এতে সম্পদে গতিশীলতা আসে। এতে প্রচুর লোক ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে, তাতে চাহিদা বা ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা হয়, কর্মসংস্থান হয়। যার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়।
সঠিকভাবে জাকাত আদায় করলে সমাজের দারিদ্র্য দূর হবে, অপরাধপ্রবণতা কমবে এবং আর্থসামাজিক বিপর্যয় থেকে জাতি রক্ষা পাবে। সর্বোপরি সুদের নাগপাশ থেকে মুসলমানগণ রক্ষা পাবেন। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে খাই-খাই মানসিকতার অবসান হয়, দাতার তালিকায় নাম ওঠে ও আত্মসম্মান সৃষ্টি হয়। এতে ধনী–গরিবের বিভেদ দূর হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা-সম্প্রীতি তৈরি হয়, সহমর্মিতা ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গঠিত হয়; এতে দাতা–গ্রহীতা উভয়ের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার হয়। সমাজদেহ থেকে কার্পণ্য, লোভ, মোহ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতাসহ নানা দুষ্ট উপসর্গ দূর হয়।
প্রয়োজনের অধিক ‘নিসাব’ পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা) বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ (সোনা-রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য) কারও নিকট এক বছর কাল থাকলে, তাকে তার বর্ণিত খাতসমূহের সমুদয় অর্থ-সম্পদের ২.৫ শতাংশ (৪৯ ভাগের ১ ভাগ) জাকাত প্রদান করা ফরজ। ঋণ থাকলে তা বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। যে ঋণ পরিশোধের জন্য কিস্তি নির্ধারিত আছে, সে ঋণের বর্তমান কিস্তি (যদি পরিশোধ না করা হয়ে থাকে) বাদ দিতে হবে। অনুরূপ বর্তমান মাসের যাবতীয় খরচও বাদ রাখবে। কারও ওপর জাকাত ফরজ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে, প্রথমে তার সম্পদ থেকে জাকাত আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ যথারীতি ব্যবহৃত হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা: ১২৮)।
জাকাত প্রদান করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার জাকাতদাতা বা আয়োজককেই নিতে হবে। যথা: কেউ আহত হলে তার চিকিৎসা ব্যয় ও পরিবারের ব্যয়ভার নিতে হবে। কেউ নিহত হলে; অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হলো জনপ্রতি ১০০ উট। একেকটি উঠের দাম সাধারণত এক লাখ টাকা; সুতরাং মাথাপিছু ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে এক কোটি টাকা, যা সরকারি নির্দেশনায় প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আদালতের সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিবার ও তার উত্তরাধিকারীদের প্রদান করতে হবে।
জাকাত ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। জাকাত বলতে ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করাকে বোঝায়। পারিভাষিক অর্থে জাকাত হলো, নিসাবধারীর সম্পদ, জমির ফসল ও খনিজ সম্পদের ওপর ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা। আল্লাহ তায়ালা জাকাত ব্যয়ের খাতগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। জাকাতের সম্পদ ব্যয়ের খাত মোট আটটি।
সেগুলো হলো এক. গরিব-ফকির যাদের নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
দুই. মিসকিন যাদের কোনো সম্পদ নেই।
তিন. ইসলামি রাষ্ট্রের সরকারকর্তৃক জাকাত, সদকা, ওশর ইত্যাদি উসুল করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি।
চার. ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য জাকাত দেওয়া। তবে এ খাতটি বর্তমানে আর প্রযোজ্য নয়।
পাঁচ. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসী।
ছয়. পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ না থাকায় ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণী ব্যক্তি।
সাত. যোদ্ধা, যারা যুদ্ধের অস্ত্র যোগাতে অক্ষম অথবা টাকার কারণে হজের কাজ পূর্ণ করতে অক্ষম বা ইলম হাসিল ও দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত গরিব মানুষ।
আট. সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ।