আজিজুল শেখ, কোলকাতা প্রতিনিধিঃ পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বুধবার থেকে সেখানকার একটি মন্দিরে পুজো দিতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, প্রায় দুশো বছর ধরে মন্দিরটিতে তাদের পুজো দিতে দেওয়া হত না। কাটোয়া অঞ্চলের গীধগ্রামে গত কয়েকদিন ধরে পুজো দেওয়ার দাবিতে মিছিল-মিটিংও করছিলেন তারা। অবশেষে বুধবার ওই সম্প্রদায়ের পাঁচজনকে পুলিশ-প্রশাসন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পুজো করিয়েছে। বৃহস্পতিবারও ওই সম্প্রদায়েরই অন্য কয়েকজন পুজো দিতে গিয়েছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

প্রথম দিনেই মন্দিরে পুজো দিয়েছেন, এমন একজন নারী, পূজা দাস বলেছেন, আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছ থেকেও শুনে এসেছি যে আমাদের সম্প্রদায়কে ২০০ বছর ধরে এই মন্দিরে পুজো দিতে দেওয়া হত না। একজন হিন্দু হয়েও এই মন্দিরে পুজো দিতে পারতাম না আমরা। সম্প্রদায়টির নাম ‘মুচি’ হলেও এদের পদবী দাস এবং আদতে দলিত ও তপশিলি জাতিগোষ্টীভুক্ত মানুষ।

স্থানীয় প্রশাসক বলেছেন, এই নিয়ম নাকি প্রায় দুশো বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এরকম একটা ঘটনা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা সংবিধানের পরিপন্থী। গ্রামবাসীরা যখন পুজো দেওয়ার অধিকারের দাবিতে সরব হয়েছিলেন, সেই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এমন একটি সংগঠন বলছে, যারা এতবছর ধরে এই মানুষদের পুজো দিতে বাধা দিত, তাদের একাংশও কিন্তু এদের মতোই তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ।

মন্দিরের সিঁড়িতেও উঠতে দিত না!
গীধগ্রামের এই প্রাচীন মন্দিরটি শিবের মন্দির। গ্রামের অন্যান্য মন্দিরে পুজো দিতে দাসদের কোনও বাধা ছিল না, শুধু বাধা দেওয়া হত এই শিবমন্দিরের ক্ষেত্রেই। প্র্রশাসনের কাছে পুজোর অধিকার চেয়ে যে চিঠি তারা পাঠিয়েছিলেন, সেখানে লেখা হয়েছে, “মন্দিরে পুজো দিতে গেলে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার, গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ বলে আমরা নিচু, মুচি, অস্পৃশ্য জাত, মন্দিরে ওঠার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমরা পুজো দিলে নাকি মহাদেব অপবিত্র হয়ে যাবে।”

গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ দাসের কথায়, “এমনিতে অন্যান্য মন্দিরে আমরা পুজো দিতাম। আবার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পাওয়া বা চাষের ক্ষেতে কাজ করা, সামাজিক মেলামেশায় কোনও কিছুতেই কোনও বাধা দিত না কেউ। শুধু এই গীধেশ্বর মন্দিরেই আমাদের উঠতে দেওয়া হত না। এমনকি সিঁড়িতেও উঠতে পারতাম না আমরা। এখন গ্রামটির যে চারজন নারী প্রথম দিন পুজো দিয়েছেন এই শিব মন্দিরে, তাদের অন্যতম পূজা দাস বলছিলেন, ধরুন বাড়িতে পরিবারের শিশু সন্তানের অন্নপ্রাশন হবে।

ওই মন্দিরের প্রসাদ খাওয়ানোর রীতি আছে। বাকি সবাই সেটা করতে পারে। কিন্তু আমাদের বেলায় সেটা করতে দেবে না। সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, আমাদের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে গিয়ে কেউ প্রসাদ এনে দেয়। কেন আমরাও তো হিন্দু! কেন পুজো দিতে দেবে না আমাদের? তার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল যে শিবের মাথায় জল ঢালবেন, সেই ইচ্ছা বুধবার পূরণ হয়েছে। হিন্দুদের উৎসব ‘শিবরাত্রি’র আগে থেকেই এই গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ প্রথমে প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেন, তারপরে মিছিল-মিটিংও করা হয়। অন্যদিকে প্রশাসনও হস্তক্ষেপ করে।

বৈষম্য হবে কেন’?
স্থানীয় মানুষদের কাছে বিষয়টা জানতে পেরে ওই গ্রামে হাজির হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের কয়েকজন সদস্য। সেই দলে ছিলেন সংগঠনটির পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক তমাল মাজি। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে আমরা যেটা বুঝতে পারি যে অন্য কোনও কিছুর ক্ষেত্রেই এই বৈষম্যের সম্মুখীন তারা হন না, ব্যতিক্রম শুধু এই মন্দিরটির ক্ষেত্রে। গ্রামে বেশিরভাগই নানা তপশিলি জাতির মানুষ, কিছু ব্রাহ্মণ, কিছু মুসলমান এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, বলছিলেন মি. মাজি। তার কথায়, আশ্চর্যের বিষয় হল এই দাস পরিবারের সদস্যদের পুজো দিতে বেশি বাধাটা দিতেন ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন। আবার বাগদি, ডোমেদের মতো যেসব অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, তাদের একাংশও এই বৈষম্যকে সমর্থন করতেন, দাসদের বাধা দিতেন।

আমরা তো সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। তাতে এটা মনে হয়েছে যে অন্যান্য যেসব দলিতরা আগে থেকেই পুজো দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেছেন, নতুন করে সেই অধিকারে কেন কেউ ভাগ বসাবে এরকম একটা মানসিকতা ছিল। কিন্তু বৈষম্য হবে কেন? অস্পৃশ্যতা কেন থাকবে?” প্রশ্ন তমাল মাজির। বিহার, উত্তরপ্রদেশ সহ উত্তর এবং রাজস্থান-হরিয়ানার মতো পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যে দলিতদের মন্দিরে পুজো দেওয়ায় বাধা সহ নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তথাকথিত উঁচু জাতের মানুষের গায়ে ছোঁয়া লেগে গেলে মার খেতে হয় দলিতদের এরকম ঘটনাও শোনা যায়।

সেখানকার রাজনীতিও অনেকটা আবর্তিত হয় এই জাতিগত সমীকরণকে ঘিরে। পশ্চিমবঙ্গে যদিও জাতিগত বৈষম্য বা কোনও দলিত সম্প্রদায়কে বাধা দেওয়ার ঘটনা বেশি সামনে আসেনি। তবে গত দেড় দশক ধরে এ রাজ্যের রাজনীতিতেও জাতিগত সমীকরণ প্রবেশ করেছে। কোন জাতির মানুষের বসবাস কোন এলাকায় বেশি নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করার আগে এ রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো সেসব বিচার বিবেচনা করছে। যেমন সবথেকে বড় তপশিলি জাতি সম্প্রদায় ‘মতুয়া’দের ভোট যেখানে বেশি, সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রার্থীই খোঁজে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এমনকি বামফ্রন্টও। ‘মতুয়া’ ভোট পাওয়ার জন্য নানা কৌশলও নিতে দেখা যায় রাজ্যের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দুই দলকেই। এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একেবারেই নতুন ধারা বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

হিন্দু হয়েও ২০০ বছর ধরে মন্দিরে পুজো দিতে দেওয়া হত না।

হিন্দু হয়েও ২০০ বছর ধরে মন্দিরে পুজো দিতে দেওয়া হত না।

প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ!
শিবরাত্রির আগে গ্রামের ১৩০টি দাস পরিবারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে পুজো দিতে চেয়ে আবেদনের পরেই হস্তক্ষেপ করে প্রশাসন ও পুলিশ। কাটোয়ার মহকুমা শাসক অহিংসা জৈন বলছিলেন, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে নিজের পছন্দের ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করার। পশ্চিমবঙ্গে এধরণের জাতপাতের বিভেদ চলে না। তবে কিছু ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এরকম একটা প্রথা চলে আসছিল। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দিতে পারি না।

বিষয়টা জানার পরেই সব পক্ষকে নিয়ে আমরা বৈঠক করি, তাদের বোঝানো হয় যে এটা ভুল। বর্তমান সময়ে এসে এধরণের বৈষম্য করা যায় না। তারাও ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন। বুধবার আমি নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ওই দাস সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পুরো সময়টা ওখানে, বলছিলেন মিজ. জৈন। গ্রামের দাস পরিবারগুলোর কেউ কেউ বলছেন যে এখন প্রশাসন-পুলিশ দেখে হয়তো কেউ কিছু বলছে না, তবে আতঙ্ক একটা আছে। সেকারণেই এখনও পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে গীধগ্রামে। মহকুমা শাসক মিজ. জৈন বলছেন, শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় নি সেখানে। কিন্তু আমরা সাবধানতা অবলম্বন করার জন্যই পুলিশ রেখে দিয়েছি। ধীরে ধীর সরিয়েও নেওয়া হবে বাহিনীকে।

ফেসবুক মন্তব্য


মতামত জানান :

 
 
 

শিরোনাম :

সম্পাদকীয়ঃ জাকাত গরীবের করুণা না হোক? লক্ষ্মীপুরে যুবদল নেতা চাঁদা না পেয়ে কাজ বন্ধ রাখতে শ্রমিকদের পেটালো ভারতে হিন্দু হয়েও ২০০ বছর ধরে মন্দিরে পুজো দিতে দেওয়া হত না কানাডার প্রধান মন্ত্রী হলেন মার্ক কার্নি, শুরুতেই ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি বাংলাবাজার থেকে ভারতীয় গরু আটক করেছে রাতের আধারে জমির ফসল তুলে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা হরিপুরে ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দুই লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড যুক্তরাষ্ট্রে বরখাস্ত কর্মীদের পুনর্বহালের নির্দেশ আদালতের ডোমারে নারীর প্রতি ধর্ষণ ও সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন রোজায় বেড়ে যাওয়া মাছ-গোস্তের দাম আগের দামে ফিরেছে আমেরিকার মিশিগানে চার্চ পরিণত হলো মসজিদে ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯৭১ সেই সব দিন চলচিত্র প্রদর্শনী ও প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত আদমদীঘিতে হেরোইনসহ বাসযাত্রী গ্রেপ্তার ঠিকাদার নিয়োগে কালক্ষেপনে সরু রাস্তায় ঘটছে মৃত্যু কবিতাঃ শূন্যে লেখা প্রেমের শপথ ঠাকুরগাঁওয়ে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন উপলক্ষে সংবাদকর্মীদের সাথে ওরিয়েন্টেশন কর্মশালা জাতীয় ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন উপলক্ষে ডোমারে অবহিতকরণ ও পরিকল্পনা সভা অনুষ্ঠিত এবারের রমজান ২৯ নাকি ৩০ দিনের, জানা গেল ঈদের সম্ভাব্য তারিখ মানুষের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ছে, প্রতিরোধে করণীয় কী? আদমদীঘিতে ডেভিল হান্টের ভয় দেখিয়ে টাকা দাবী, ওসির অপসারণ চেয়ে অভিযোগ ঠাকুরগাঁও হরিপুরে আইন-শৃঙ্খলা মাসিক সভা অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে আইসিজে মামলায় আমরা সফল হতে চাই : প্রধান উপদেষ্টা শুল্ক ইস্যুতে দফায় দফায় ভারতের কঠোর সমালোচনা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল,অথচ এখন আহাজারি করতে হচ্ছে নওগাঁর সাপাহারে ধর্ষণ ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন ডোমারে বিএনপির আয়োজনে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত ফিতরা কী? ইসলাম ধর্মে এর হিসাব কীভাবে করা হয়? চিরিরবন্দরে দুর্যোগ প্রস্তুতি সভা ও অগ্নিকাণ্ড বিষয়ক মহড়া অনুষ্ঠিত টাঙ্গুয়ার হাওরে বিষ প্রয়োগে গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির ১১জনের বিরুদ্ধে মামলা সারাদেশে ধর্ষন, নিপীড়নের বিচারের দাবীতে চিলাহাটিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত
Translate Here »