মুক্ত কলম নিউজঃ ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে যে চরম টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি ব্যাংককে দুই নেতার বৈঠকের মাধ্যমে প্রশমিত হওয়ার আভাস দিয়েছিল। বৈঠকটি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। তবে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জনমনে ভিন্ন বার্তা ছড়াচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করছে, ভারত সরকার বাংলাদেশের সরকারকে না জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশের সরকারপ্রধানের এই আলোচনা কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। অর্থাৎ ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানোর সুযোগ বাংলাদেশের আর থাকবে না।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা এই সিদ্ধান্তকে যথাযথ মনে করছেন না। তাদের মতে, ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সরকারকে অবগত না করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই জনমনে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে সংবেদনশীল সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্তে আরও সাবধানী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ইউনূস-মোদির বৈঠকে দুই নেতা দুদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তারা একে অপরের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন এবং কিছু ইস্যুতে পাল্টা বক্তব্যও দিয়েছেন। বৈঠকটি সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, এটি দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার একটি নতুন পরিবেশ তৈরি করবে। তবে, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নতুন করে নেতিবাচক অবস্থান সৃষ্টি করেছে এবং উভয়পক্ষের মধ্যে অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
ভারতের এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে এক কূটনীতিক বলেন, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক থাকলে সেটি কারও জন্যও ভালো হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতে ওয়ার্কিং রিলেশন রাখার কথা বলেছে এবং তার আন্তরিকতা আছে। ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল ইতিবাচক, যেখানে উভয়পক্ষ তাদের অবস্থান তুলে ধরে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণ ব্যাখ্যা করলেও, এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে সেটি তাদেরই বলা উচিত।
এক সাবেক কূটনীতিক বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। তিনি বলেন, অস্বস্তি বা টানাপোড়ন প্রশমিত করার জন্য দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সেটা ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বৈঠক সম্পর্কে যে পরস্পরবিরোধী সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সংবেদনশীল সময়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য সম্পর্কের প্রভাব ফেলতে পারে, তাই উভয়পক্ষের সাবধানী হওয়া উচিত ছিল। ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে, ভারত তা বলতে পারবে, আর বাংলাদেশ কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে চাওয়ার সুযোগও রয়েছে।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) এক সার্কুলারে ঘোষণা করেছে, দেশটির স্থলসীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ভুটান, নেপাল, মিয়ানমারসহ তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
২০২০ সালের ২৯ জুন এক আদেশের মাধ্যমে ভারত এই সুবিধা প্রদান করেছিল। ওই সময়ে, বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর এবং কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। তবে এখন সেই সুবিধা প্রত্যাহার করেছে ভারত।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তের একদিন পর, বুধবার প্রথম এই খবরটি ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায় এবং এতে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এদিন সন্ধ্যায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেপাল বা ভুটানগামী পণ্য চালানগুলোর ওপর প্রযোজ্য হবে না।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পণ্যজট সৃষ্টি হচ্ছিল। এই কারণে আমাদের নিজস্ব রপ্তানিতে বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যাকলগ তৈরি হচ্ছিল। ফলে, ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে, ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে নেপাল বা ভুটানে পণ্য পরিবহনের ওপর এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব পড়বে না।
ব্যাংককে ইউনূস-মোদির বৈঠক শেষে প্রকাশিত পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের প্রভাব ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তে পড়েছে কি না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা হতে পারে, আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে, ভারতের ব্যবসায়ীরা এই সুবিধা বাতিলের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, সেটাও ঠিক।
তিনি বলেন, ভারত সরকার ২০২০ সাল থেকে আমাদের এই সুবিধা প্রদান করছে এবং গত পাঁচ বছর ধরে আমরা এটি ব্যবহার করেছি। যদি তারা বাতিল করতে চায়, তবে তারা বাংলাদেশকে আগে জানিয়ে আমাদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল, যা কূটনৈতিকভাবে সঠিক কাজ হতো।
হুমায়ুন কবির বলেন, কিন্তু এটি একতরফাভাবে বাতিল করা হয়েছে, ফলে জনমনে বা মানুষের ব্যাখ্যার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আমি মনে করি, যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে স্থান, কাল, পাত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখন বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক একটি সংবেদনশীল সময়ে রয়েছে, তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত, বক্তব্য বা অবস্থান প্রকাশের সময় বিষয়গুলোর প্রতি সবার গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক বলেন, এই মুহূর্তে ক্ষতির পরিমাণ বলা কঠিন। কারণ, আমরা এই সুবিধাটি নিয়েছিলাম কোভিডের সময়, যখন সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছিল না। এখন সেই সমস্যা আর নেই, শুধু লোহিত সাগরে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে, সেটিও এখন কাটিয়ে উঠতে পারব। ফলে, অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ আর থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, তবে আমরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব, এমনটি আমি মনে করি না। বরং, এই সিদ্ধান্তের ফলে ভুল ধারণা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেটি পরিহার করা সম্ভব ছিল।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপরই বুধবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কার্যালয়ে। বৈঠকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে বৈঠকের আলোচনা বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য জানতে পারেনি ঢাকা পোস্ট।
এদিকে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পেট্রাপোল সীমান্ত বন্দর থেকে চারটি বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাক ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি গণমাধ্যম। বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাক ফেরত পাঠায় ভারত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র নীতিমালা অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশ চাইলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ফোরামে বা ডব্লিউটিওতে উত্থাপন করতে পারে। একইসঙ্গে ভারত সরকারের কাছে কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগও রয়েছে।