আব্দুল্লাহ্ আল মামুন,পঞ্চগড় প্রতিনিধি: মাস খানেক আগেও পানির প্রবাহ ছিল নাম মাত্র। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে প্রায় ১০ কিলোমিটার ক্যানেল পেয়েছে পূর্ণ যৌবন। স্লুইজ গেটের স্পিলওয়ের পানি ফোয়ারায় আনন্দে লাফালাফি করছে একদল শিশু। আর তা দেখছে উৎসুক কিছু পর্যটক। বিকেলের মেঘমাখা রোদে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বেশ কিছু মানুষ। ক্যানেলের দু’পাশে হাজারও বৃক্ষরাজীর ছায়াতলে পাখির কলকাকলীতে মূখর পরিবেশে খোশগল্পে মগ্ন বেড়াতে আসা কয়েক যুগল। এটি মিনি কক্সবাজার বলে খ্যাত পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের পাথরাজ বাঁধ প্রকল্পের চিত্র।
পঞ্চগড় জেলা সদরের রেলস্টেশন সংলগ্ন ঘাটিয়ার পাড়া থেকে বাঁধে বেড়াতে এসেছেন শিক্ষক আতাউর-সেলিনা দম্পত্তি। তারা জানান, গত বর্ষা মৌসুমে এই বাঁধের কথা শুনেছিলাম। এবার বেড়াতে এলাম। অদ্ভুদ লাগছে। পঞ্চগড় জেলার মধ্যে এমন মনোরম পরিবেশ থাকতে পারে তা কোনদিন ভাবতেও পারিনি। ক্যানেলের চারপাশে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। স্লুইজ গেটের ওপরের রাস্তা দিয়ে নিচে তাকালে মনে হয় এটি একটি ঝরণাধারা। গেটের উপচে পড়া এবং ফাঁকফোকর দিয়ে গলিয়ে আসা পানি স্পিলওয়ে দিয়ে নিচে পড়ছে। এ এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সারাবছর যদি এমন দৃশ্য দেখা যেত তাহলে কতই না ভাল লাগত।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৫ সালে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের হরিপুর মৌজায় পাথরাজ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। আমন মৌসূমে অনাবৃষ্টিতে খরা মোকাবেলায় সম্পুরক সেচ প্রদান করার জন্য প্রকল্পটি তৈরি করে ইপি ওয়াপদা। এই প্রকল্পের পানি দিয়ে ময়দানদিঘী এলাকার হরিপুর, লাঙ্গলগ্রাম ও পাশ্ববর্তি ঝলই শালশিরি গ্রামের জমিতে সেচ প্রদান করা হত। ১৯৮৫ সালের বন্যায় প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেচকাজ ব্যহত হয়। পরবর্তীতে পাথরাজ নদীর পানির স্বল্পতা, নিয়মিত মেরামত কাজ না হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকল্পটি হতে এলাকার মানুষ সেচ সুবিধা বঞ্চিত ছিল। এলাকার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পুনরায় পাথরাজ বাঁধ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্যারেজের স্পীলওয়ে জিওটেক্স ব্যাগ দিয়ে মেরামত কাজ করা হয়েছে। গত রবি মৌসুমে এই পানি ব্যবহার করে ৫শ’ একর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছিল। এতে উৎপাদিত হয়েছিল অতিরিক্ত ৯শ’ মে. টন ধান। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। বাঁধের ৯.১২ কি.মি. ক্যানেলের ডাইকের উভয় পাশে প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় সৃষ্ট ১৫ একরের একটি জলাশয়ে মাছচাষ এবং হাঁস পালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। লিড এজেন্সি পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ প্রকল্প এলাকায় সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সেচের পাশাপাশি প্রকল্প ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। ব্যারেজের মনোরম সৌন্দর্য এবং সবুজ বেষ্টনী ও নদীর পুরাতন গতিপথ পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে বছরজুড়েই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠাকুরগাঁও উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রফিউল বারী জানান, বন্ধ থাকার ২৪ বছর পর পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ ও সেচ খাল ক্যানেল সিস্টেমের কিছু অংশ মেরামত কাজ করে সেচ সুবিধা প্রদান শুরু করেছে। সেচ খালের দু’পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম এলেই প্রকল্প এলাকার চেহারা পাল্টে যায়। এখানকার মনোরম সৌন্দর্য দেখতে দুর দুরান্ত থেকে মানুষজন এখানে আসে। সংস্কার করে পুরো বাঁধ সচল করা গেলে এখানে বছরজুড়েই পর্যটকদের ভির থাকবে।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোষ বর্মন জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সাময়িক সংস্কার কাজ করে সেচ কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় শোভাবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। এরই মধ্যে এলাকার মানুষ সেচ সুবিধা পাওয়া শুরু করেছেন। প্রকল্পের ৯.১২ কিলোমিটার সেচ নালা পুরোপুরি সংস্কার করে পুরোদমে প্রকল্পের কার্যক্রমে শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।