চাকুরী জীবনের আগে জয়পুরহাটে রেডক্রসের কাজ করেছি।তখন মহকুমায় রেডক্রসের কোন কর্মকর্তা বা অফিস ছিলনা।এসময় আমি মহকুমা রেডক্রসের দ্বায়িত্ব পালন করেছি। প্রচুর কাজ করেছি। ফলে আমার অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডে অনুষ্ঠেয় যুব রেডক্রস কংগেসে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেবার সম্ভবত ৪ জনের একটি ডেলিগেট যাবে। বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি মহকুমা প্রশাসগণের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন, এ বিষয়টি আমি জানতামনা। প্রাথমিক ভাবে আমি নির্বাচিত হই। মহকুমা প্রশাসক খুশী হয়েছিলেন তার মহকুমা থেকে একজন প্রতিনিধি কংগ্রেসে যোগদান করতে পারবে এই ভেবে। সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকটাক করা হলো। তিনি মাঝে মাঝে ব্রিফিংও দিতেন।
রেডক্রসের সেক্রেটারী যিনি একজন রাজনীতিবীদ ছিলেন, এবং প্রয়োজনে দল বদল করতেন, প্রভাবশালীও বটে। তিনিতো চাইতেই পারেন তার ছেলে যাবে। নির্বাচন করবে রেডক্রস সোসাইটি, নির্ধারিত ক্রাইটেরিয়া আছে। তিনি চাইলেন কিন্তু তার ছেলে কোন ক্রাইটেরিয়ায় পড়েনা। মনোনয়নপত্রে তার স্বাক্ষর লাগবে। তিনি স্বাক্ষর করলেননা। মহকুমা প্রশাসক আমার কাগজটা পাঠাতে পারলেননা ক্রাইটেরিয়া না মেলার জন্য আর কোন মনোনয়ন পাঠালেননা। ফলাফল যা হবার তাই। প্রতিনিধিত্ব করা হলোনা। সে সময়ই আমি রেডক্রসের আজীবন সদস্য হয়েছিলাম।
তবে সেজন্য আমি রেডক্রসের কাজ করা বন্ধ করেছি তা নয়।স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করলে আপাতত: মুল্য পাওয়া না গেলেও যে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয় তা কর্মজীবনে খুবই উপকারে লাগে।কয়েক বছর পর সরকারি চাকুরীতে যোগ দিলাম। জয়পুরহাট ছাড়লাম। চাকুরীকালীন কমর্ক্ষেত্রে পত্রের মাধ্যম জানিয়ে দিতাম আমি রেডক্রসের আজীবন সদস্য, বর্তমানে এই জেলায় কর্মরত আছি। তারা সানন্দে আমাকে তাদের সদস্য করে নিয়েছেন, মিটিং প্রোগ্রাম করতাম।
সাধারণ সভা করতাম।২/১ জায়গায় সম্পাদকের দ্বায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধও এসেছে,তবে বিনয়ের সাথে বলেছি আমি সরকারি চাকুরী করি বদলীযোগ্য বিষয়। আপনারা স্থানীয় মানুষ এসব দ্বায়িত্বে আপনাদেরই থাকা উচিত। তবে কাজ করতে কোন দ্বায়িত্বে থাকা জরুরী নয়। সব জেলাতেই সাধ্যমতো ভুমিকা রাখার চেষ্টা করেছি।
তবে একটি জেলাতে তা পারিনি। সে জেলার কর্মকর্তাদের বছর তিনেক ধরে চেষ্টা করে বোঝাতে পারিনি আমি আজীবন সদস্য, এখানে থাকি, আমার সদস্যপদ এখানে আনা যাবে। অফিসে অনেকবার গিয়েছি। অফিসের কর্মচারী ছাড়া আর কেউ আছে কিনা আমি জানতে পারিনি। সম্পাদক সাহেবের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করেছি তবে সফল হ্ইনি। তাকে কোন দিন অফিসে পাইনি। হয়তোবা তিনি দাপ্তরিক কাজে ব্যাস্তো থাকেন।
যেহেতু এই জেলা শহরে আমি বসবাস করছি সুতরাং সদস্য পদটি স্থানান্তর করবো। এরকম বিধান আছে।জেলা কর্তৃপক্ষ আমাকে হাইকোর্টতো দেখিয়েছেন, প্রিভি কাউন্সিলের কথাও বোধ হয় ইঙ্গিতে বলেছেন তবে আন্তর্জাতিক আদলতে যেতে হতে পারে কিনা তা অবশ্য বলেননি। ৩ বছর ধরে আবেদন, নিবেদন, যোগাযোগ, ব্যাখ্যা বিবৃতি . কাগজপত্র জমা দেওয়া নেওয়া করেছি,জয়পুরহাট থেকে ছাড়পত্র এনেছি কিন্তু হয়নি।
অবেশেষে জয়পুরহাটের অফিস আমার আইডি কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সময় লাগলেও পেয়েছি। আমি এখন পৃথিবীর যে কোন দেশে গেলে এর জন্য মর্যাদা এবং সুবিধা পাবো।এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও আমি নিরপেক্ষ ও নিরাপদ ব্যক্তি।
জয়পুরহাটের রেডক্রস কার্যক্রম বেশ সচল এবং সক্রিয়। ৮০ এর দশকে আমরা যেভাবে এই সংগঠনকে সক্রিয় রেখেছিলাম তারা সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। সেখানকার রেডক্রস অফিসে গেলে মনে হবে এটা একটা সরকারি অফিস। সম্পাদক সাহেব নিয়মিত অফিসে বসেন এবং ফুলটাইম। অন্যান্য কর্মকর্তা বা কর্মচারী যারা আছেন তারাও তাই। ২তলা বিশিষ্ট অফিস বিল্ডিং এর উপরের তলায় মহিলা সংস্থার কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র। নীচ তলায় শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন একজন বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসক বসেন। মাত্র ১০০ টাকা ফি দিয়ে চক্ষু রোগীরা সেবা নিতে পারেন। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। তিনি স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, অত্যন্ত যতœসহকারে চক্ষু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। তাঁর বাবাও একজন ভালো ডাক্তার ছিলেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তবে ডাক্তার সাহেব বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা দেন।
যেদিন আমি আইডি কার্ড পেলাম, সেদিন আবার মুল্যায়ন টীম এসেছিল তারা ডকুমেন্টারী তৈরি করছিল। বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে।আমাকেও সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। আমি বলার চেষ্টা করেছি রেডক্রস অফিসের তরফ থেকে এই আয়োজনের ফলে এলাকার চক্ষু রোগীরা প্রায় বিনা মুল্যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। এখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে পারলে ছোটখাট অপারেশনও করা যেতো। তাতে করে এলাকার রোগীরা দারুন উপকার পাবে। রেডক্রস কর্তৃপক্ষ যদি এর সাথে সাথে একজন নিউট্রিশিয়ানকে সেবা দেওয়ার জন্য নিয়োগ করতে পারে তাহলে আরো ভাল হবে। কেননা আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। আমাদের সঠিক খাদ্যাভাসের অভাবে, ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার, কোলষ্টেরল সমস্যায় ভুগছি। অথচ সঠিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের এসব জটিল সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি দিতে পারে।
আমি আমার রেডক্রস আইডি কার্ড বিলম্বে পেলাম কেন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। রেডক্রসের জেলা অফিসের কাজ এসব বিষয়ে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সদস্য সংখ্যা বাড়ানো। এটা একটা আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যে কেউ এর সদস্য হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো সদস্য বেশী হলে বার্ষিক সাধারণ সভায় অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে, কেউ কেউ বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়েও যেতে পারে। সুতরাং ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কি? আমৃত্যু পদে থাকার আকাংখ্যা বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছাসেবী এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ লাভের গৌরব থেকে মানুষদের বিরত রাখা হয়।
নির্ধারিত ফি দিয়ে নিজ নিজ জেলায় আবেদন ফরম পুরণ করবেন। আপনার দ্বায়িত্ব শেষ অফিসের কাজ হলো আপনার আবেদন পত্র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো। আপনার আজীবন সদস্য সনদ চলে আসবে। আইডি কার্ডের জন্য নির্ধারিত আবেদন ফরম আছে পুরন করে জমা দিলে অফিস তা কেন্দ্রে পাঠাবে আপনি সময়মতো আইডি কার্ড পাবেন।
আমার আইডি কার্ড পাওয়ার খবরে অনেকে সদস্য হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।অনেক দেরীতে পাওয়ার কারণে হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। আমার প্রিয় ২ জন সরকার ফরহাদ এবং ফারুক জুলু তাদের মধ্যে অন্যতম। জুলু যে বিষয়টা বলেছেন তাতে হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে। জুলু একজন খুব ভালো ফুটবলার ছিলো। ভাগ্যান্বেষনে বিদেশে গিয়েছিলেন ফিরে এসেছে। একজন খেলোয়ার হিসাবে খেলার উপকরণের দোকান করেছেন। এলাকার খেলোয়াররা কমপক্ষে তার কাছে নির্ধারিত মুল্যে ক্রীড়া সামগ্রী কিনতে পারে। গলা কাটার অভ্যাস রপ্ত করতে পারেনি। তবে ঠাকুরগাঁও শহরে সব ভালো কাজের সাথে জুলু আছে। রমজান মাসে ৫ টাকার বাজার, বন্যার সময় দুর্গত মানুষদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া, সহায় জুলুম বস্তি নামে একটি সংগঠন করে তার মাধ্যমে তরুনদের সংগঠিত করে অসাধ্য সাধন করে । সেই জুলু যখন প্রশ্ন তোলে সে ৮৮ সালে সদস্য হয়েছে , ঠাকুরগাঁওয়ে রেডক্রসের অফিস আছে কিনা তা তার জানা নাই। তার মানে রেড ক্রস ঠাকুরগাঁওয়ে এমন কিছু করেনা যার ফলে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ রেডক্রস কর্মকান্ড সম্পর্কে জানবে।
৮ মে বিশ্ব রেডক্রস দিবস। মনের টানে গিয়েছিলাম নিশ্চয় রেডক্রসের কোন প্রোগ্রাম হবে সেই আশায় ।তবে যা দেখেছি সেটা না বলাই ভালো। কিছু ছেলে মেয়ে এসেছিল তাদের জিজ্ঞাসা করার তারা বলতে পারেনি তারা কেনো এসেছ। শুধু এটুকু বলা যায় স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আমরা জাতীয় পতাকা উড়াতে শিখিনি, সেটাই ঠাকুরগাঁয়ের রেডক্রস আমাদের মনে করে দিয়েছে।