নাগরিক ভাবনা,ডা: নূরল হক, দিনাজপুর বিরামপুর থেকেঃ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা নিয়ে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বহুবার পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। নয়া দিল্লীতে অনেকবার বৈঠক হয়েছে মন্ত্রিপর্যায়ে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অপতৎপরতা বিরুদ্ধে প্রেস নোট পাঠিয়েছিল। কিন্তু সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ) কর্তৃক গুলি করে হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণ অব্যাহত রয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রোববার রাতে মায়ের সাথে ভারতের ত্রিপুরায় থাকা ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজার কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৪ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহত হয় । সে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো।
১৫ বছর বয়সি ফেলানি খাতুনকে হত্যা করা হয় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারী। ফেলানি কুড়িগ্রাম অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে তার পিতার সঙ্গে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল। ফেলানি হত্যাকান্ডের পর তার লাশ ৫ ঘন্টা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল। ঘটনা প্রায় একই। ফেলানি হত্যাকাণ্ড দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল কিন্তু আলোড়নের পরও শাস্তি হয়নি ফেলানি হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যের। শুধু কিশোরী ফেলানী বা স্বর্ণা দাস নয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ নিয়মিত বাংলাদেশের মানুষকে সীমান্তে গুলি করে বা নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করছে। ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গেলে বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালায়।
ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটী বলেছেন, সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প শুনানো হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান হয় বলে চোরাকারবারীদের হত্যা করা হয়।
বাস্তবে এই সব গরু আনা হয় ভারতীয় অভ্যন্তরে দুই আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরু গুলি হাঁটিয়ে ,ট্রেনে, ট্রাকে করে আনা হয় । তখন তারা দেখেও আটকায় না, কারণ তারা ভাগ পায়। যখন ভাগ পায় না, ভাগ- বাটোয়ারায় মেলে না, তখন বিএসএফ হত্যাযজ্ঞ চালায়। (বাংলাদেশ চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা? ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ডয়েচে ভেলে)
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড চালালেও বাংলাদেশের বিগত সরকারের দিক থেকে কোন প্রতিবাদ জানানো হতো না । হাসিনা সরকার একদিকে ভারতকে একতরফাভাবে ট্রানজিট, বন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসা সহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে গেছে অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে আন্ত -সীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়নি এবং সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে কারাগারে পরিণত করে একের পর এক বাংলাদেশ নাগরিককে হত্যা করছে। বহুবার সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেনি ভারত।
দীর্ঘদিন ধরে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু দাবি করে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশের সীমান্তে এত হত্যাকান্ড হয়েছে, নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতের পেনাল কোড কিংবা আন্তর্জাতিক কোন আইনে নিরস্ত্র নাগরিককে গুলি করে বা নির্যাতন করে মেরে ফেলার বিধান নেই । কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করলে তাকে গ্রেফতার করে বিচার করা যেতে পারে
চলতি বছরে ২০২৪ সালে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৩ জন, আহত হয়েছেন ১১ জন। অধিকার নামের মানবাধিকার সংস্থার সূত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ জুন পর্যন্ত ৫৮২ জন নিহত ৭৬১ জন আহত হয়েছেন। সরকারের হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৯ বছরে বিএসএফের হাতে ২৯১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। বেসরকারি আরেকটি হিসেবে তথ্য পাওয়া গেছে ,১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে বিএসএফের গুলিতে ১ হাজার ৪১৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন ।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বাংলাদেশ নাগরিক হত্যা নিয়ে দু’ দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বহুবার পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সীমান্ত সমস্যা বিশেষত বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে ওইসব বৈঠকে । কিন্তু সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ হয়নি । বরং এ নিয়ে ঢাকা দিল্লি বৈঠক কিংবা পতাকা বৈঠক শেষ হতে না হতেই সীমান্তে আবারও বাংলাদেশের নাগরিককে হত্যা করেছেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। শুধু তাই নয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার পরপরই যেন বিএসএফ নতুন উদ্যমে বাংলাদেশী হত্যাই মনোযোগী হয়। সীমান্তে নির্বিচারে হত্যার অপরাধে কোন বিচার হয় না, দায়বদ্ধতা আসে না, অপরাধবোধ মনে করে না । আধিপত্যবাদ এরা মধ্য দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে বাংলাদেশের উপর দাদাগিরি করা। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সবচেয়ে বেশি সুসম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব এটা কি মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ?
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত (লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত ) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সীমান্তে পিঠ না দেখাতে বলেছে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই মুহূর্তে প্রেস নোট পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা যথার্থ ও সাহসী এবং এটি দুই দেশের সম্পর্কের ন্যায্যতার ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেবে। বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি’র মনোবল বাড়াতে হবে এবং তাঁদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেওয়া দরকার। আমরা চাই আর যেন একজন বাংলাদেশীকে বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারাতে না হয়।