এম.মাসুম আজাদ: ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় মধুপুর ছেড়ে কালা লক্ষীপুর গ্রামে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র না নিয়ে গড়ে তোলা অবৈধ চারকোল কারখানার (পাটখড়ির ছাই থেকে কার্বন তৈরির কারখানা) ছাই ও কালো ধোঁয়ায় মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আর এ পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর। শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা ও হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। একই কারণে কমছে ফসলি জমির উৎপাদনও।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুপুর কালা লক্ষীপুর গ্রামে তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের আড়ালে
গড়ে তোলা হয়েছে এই চারকোল কারখানা। এই কারখানায় পাট খড়ির ছাই থেকে তৈরি করা কার্বন চীনে রফতানি করা হয়। যা চীনে মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ, কার্বন পেপার, ফটোকপির কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশ ও প্রসাধন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবাসিক এলাকায় শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকলেও চারকোল কারখানার মালিকেরা বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর কারখানা পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিনে আনা হয় পাটখড়ি। এরপর সেগুলো বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুন জ্বালানো হয়। ১০-১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে কোনোভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চার দিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ক্র্যাশিং করে কার্বন প্যাক করা হয়। চুল্লি জ্বালানোর সময় কারখানা থেকে প্রচুর ধোয়া নির্গত হয়। এই ধোয়াতেই মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। কালা লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা
মো. হাবিব জানান, কার্বন তৈরির কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আশপাশের আকাশ কালো হয়ে যায়। ধোঁয়ার কারণে রাতে ঘরে থাকা যায় না। ঘরে থাকলেও চোখ জ্বলে। দূষিত ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সী মানুষ শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা ও হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। একই গ্রামের মো. ইসাহক আলী জানান, ধোঁয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থ বাতাসের সঙ্গে মিশে গাছপালায় লাগে। এতে এলাকার গাছপালায় ফলন কমে গেছে। আমের মৌসুমেও গাছে মুকুলের দেখা পাওয়া যায় না। রাতে ঘরে শুয়ে থাকলে সকালে কাশির সঙ্গে ছাই বের হয়। মো. হারুন জানান, এ কারখানার কারণে আশপাশের এলাকার ফসলি জমিরও উৎপাদন কমে গেছে। কৃষকরা জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেও ফলন বাড়তে পারছেন না। গ্রামবাসী চান দ্রুত এই কারখানাটি এখান থেকে অপসারণ করা হোক।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কালা লক্ষীপুর গ্রামে চারকোল কারখানায় গেলে কারখানার কর্মচারীরা জানান, ভেতরে সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ, তাছাড়া আমরা মালিকের অনুমতি ছাড়া দরজা খুলতে পারবো না। কথা হয় কারখানার সহকারী সিইও জুবায়ের এর সাথে,তিনি জানান আমি ঢাকায় আছি আপনি আগামীকাল অফিস টাইমে আমাকে ফোন দিন,কিন্তু আপনার কারখানায় সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবেন না কেনো? এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন আমাদের ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা আছে সাংবাদিক প্রবেশ করতে হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন।
আপনাদের ওখানে কি অবৈধ কোনো কার্যকালাপ করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমাদের পরিবেশের ছাড়পত্রসহ সবই ওকে আছে আপনি আগামীকাল আমার সাথে যোগাযোগ করেন। এছাড়াও তিনি বলেন আমাদের যদি কারখানায় কোনো সমস্যা থাকে তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসন এসে বন্ধ করে দিয়ে যাক। খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই চারকোল কারখানার মালিকের নাম নাজমুল তার স্থানীয় ঠিকানা নোয়াখালী। কারখানার বিস্তার অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে মালিক নাজমুলকে ফোন দিলে তিনি বলেন আমি মিটিংয়ে আছি,মিটিং শেষে আপনাকে ফোন দিচ্ছি এর পরে আর কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের ডা. দেবাশীষ জানান, বেশি পরিমাণ কার্বন নিঃসৃত হলে বাতাসের সঙ্গে কার্বন অণুগুলো মিশে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, হাঁপানিসহ ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি রোগ এবং বিভিন্ন প্রকার চর্ম রোগের আশঙ্কা থাকে এবং এটা একসময় অবশ্যই হবে। ঝিনাইদহের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্রীরুপ মজুমদারের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ঝিনাইদহের কোনো চারকোল কারখানার অনুমতি নেই। তবে একটি কারখানা পরিবেশ অধিদপ্তরে অনুমতির জন্যে আবেদন করেছেন,কিন্তু তাদের আবেদন গ্রহণযোগ্য নহে, কারণ আবাসিক এলাকার মধ্যে এই ধরনের কারখানা স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব চারকোল কারখানার বিরুদ্ধে দ্রুতই অভিযান চালানো হবে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া জেরিন বলেন, আমার বিষয়টি জানা ছিলো না,আপনাদের মাধ্যমে আমি অবহিত হলাম, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পরিবেশের ছাড়পত্র বিহীন, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা চারকোল কারখানার বিষয়ে কথা বলতে ঝিনাইদের জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নাই।
অত্র এলাকার জনগণের দাবি জনস্বাস্থ্য ও কৃষি বাচাতে আবাসিক এলাকা থেকে এই পরিবেশের ছাড়পত্রহীন চারকোল কারখানা উচ্ছেদ করা হোক